শুক্রবার, ০১ অগাস্ট ২০২৫, ০১:৪০ পূর্বাহ্ন
সিলেট প্রতিনিধি: টানা বৃষ্টিপাত আর পাহাড়ি ঢলে সিলেটে আট লাখেরও বেশি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। গত শুক্রবার থেকে মহানগর ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির দেখা দেয়। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, নগরীর ২৩টি ওয়ার্ডের ৫০ হাজার মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। আর আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ২ হাজার ৫০০ জন। জেলার ১৩টি উপজেলার ১০৬টি ইউনিয়নে ১ হাজার ৫৪৮টি গ্রামের ৮ লাখ ২৫ হাজার ২৫৬ জন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪৪৯ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছেন। তাদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে ৫৭৬টি আশ্রয়কেন্দ্র।
জেলার গোয়াইনঘাট উপজেলায় সবচেয়ে বেশি মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের ২২৩টি গ্রামে ১ লাখ ২৩ হাজার ৮০০ জন মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ১ হাজার ৪৪০ জন।
উপজেলার সব সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় জেলা শহরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন আছে। গোয়াইনঘাট-সারিঘাট, গোয়াইনঘাট-রাধানগর-জাফলং, গোয়াইনঘাট-ফতেহপুর-সিলেট সদর ও গোয়াইনঘাট-সালুটিকর সড়কটি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
কোম্পানীগঞ্জে সবচেয়ে বেশি মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। উপজেলার ৬টি ইউনিয়নের ১১৩টি গ্রামের ৯৫ হাজার ৫০০ জন বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন। একই সময় আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন ৭ হাজার ৩০৩ জন। উপজেলার বঙ্গবন্ধু মহাসড়ক বাদে বাকি সব সড়ক পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে। ফলে উপজেলার প্রত্যন্ত এলাকার মানুষজন নৌকা ছাড়া বাড়ি থেকে বের হতে পারছে না। আর জেলার ১৩ উপজেলার মধ্যে বালাগঞ্জ উপজেলায় কম মানুষ বন্যায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং জকিগঞ্জেও কম মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, ‘উপজেলার সব এলাকা বন্যায় প্লাবিত। যাদের ঘরবাড়িতে বেশি পানি উঠেছে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। আমরা বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসহায়তা দিচ্ছি।’
সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের সহকারী আবহাওয়াবিদ শাহ মো. সজীব হোসাইন বলেন, ‘গত ২৪ ঘণ্টায় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে (মঙ্গলবার সকাল ৯টা থেকে বুধবার সকাল ৯টা পর্যন্ত) ১১০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। সিলেটে গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত) ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর বুধবার সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ১১০.২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা যায়, সিলেটে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় সিলেটের তিনটি নদীর ছয়টি পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস বলেন, ‘বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। তাই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে সময় লাগবে। গত পাঁচ দিনে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১ হাজার ৬০০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টিপাত হয়েছে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের (সিসিক) জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজলু লস্কর বলেন, ‘নগরীর ৪২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৮টি ওয়ার্ডের ৮০ হাজার মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। নগরীর ৮০টি আশ্রয়কেন্দ্রের মধ্যে ২২টিতে মানুষ উঠেছে। আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যাকবলিত এলাকায় রান্না খাবার, শুকনা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। নগরীর বন্যা পরিস্থিতি দেখে তাৎক্ষণিক নগদ ১০ লাখ টাকা, ১০০ মেট্রিক টন চাল ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার ত্রাণ সহায়তা প্রদান করেন প্রতিমন্ত্রী মো. মহিবুর রহমান।’
বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় জেলার সব পর্যটনকেন্দ্র অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার বন্ধের এই ঘোষণা দেন সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন। বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সভা করে পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করেন। এর আগে গত ৩০ মে সিলেটের সব কটি পর্যটনকেন্দ্র বন্ধ রাখার ঘোষণা দেওয়া দেওয়া হয়েছিল। পরে ৭ জুন খুলে দেওয়া হয়।
সিলেটে বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন ও ত্রাণ বিতরণ করেছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মো. মুহিবুর রহমান, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী, সিলেট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমদ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসান।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মোবারক হোসেন বলেন, ‘মোটামুটি সিলেটের সব জায়গায়ই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। আমাদের সর্বশেষ রিপোর্টে ৬৫৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৯ হাজার ৯৪৯ জন মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন। সবগুলো আশ্রয়কেন্দ্রেই আমাদের নজরদারি রয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়নেই আমাদের ট্যাগ অফিসার রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ সবাইকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বন্যা পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি। পানি অল্প একটু কমলেও আবার বৃষ্টিতে আর কমেনি। গত ২৯ মে থেকে সিলেটে ১ হাজার ৪৯৫ বস্তা শুকনো খাবার, ৬৩১ টন টন জিআর চাল, ২৭ লাখ ৭৫ হাজার নগদ টাকা, ৯ লাখ করে শিশুখাদ্য ও গোখাদ্য উপজেলা পর্যায়ে উপবরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এগুলো ইউএনওরা বণ্টন করছেন।